• ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩১শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২২শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

বিসিসি শত কোটি টাকা লোপাটের তথ্য উদ্ঘাটন

admin
প্রকাশিত মার্চ ৫, ২০১৯, ১৩:০৪ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ এক হাজার ভুয়া কর্মচারীর নামে প্রায় দেড় যুগে শত শত কোটি টাকা লোপাটের মাধ্যমে একটি লোকসানি সংস্থায় পরিণত করা হয়েছিলো বরিশাল সিটি কর্পোরেশনকে। আর এসময়ে বকেয়া বেতনের দাবিতে নাগরিক সেবা বন্ধ করে দফায় দফায় ধর্মঘটও পালন করেছে নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নির্বাচিত নতুন মেয়র হিসেবে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র চার মাসের মধ্যে এ বিপুল অঙ্কের টাকা উত্তোলন করে লোপাটের ঘটনা উদ্ঘাটন করেছেন। নগর ভবনের হিসাব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে স্টাফদের বেতন দেয়ার পরেও বিসিসির রাজস্ব আয় দিয়েই উন্নয়নখাতে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতির এ বিরাট ফাঁক বন্ধ করা হয়েছে। ফলে গত তিন মাসেই সব বকেয়া পরিশোধের পর বিসিসির কোষাগারে জমা হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নগর ভবনের বাজেট কাম-হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোঃ আক্তারউজ্জামান বলেন, নতুন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের পরই অতীতের এ সাগর চুরির বিষয়টি ধরা পরেছে। এ ব্যাপারে তদন্তে যারা দায়ী হবেন তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পূর্ববর্তী মেয়রগণ অতিরিক্ত লোকবলের কারণে বিসিসিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে আসছিলেন। এরমধ্যে সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের সময় ছাড়া মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও মজিবর রহমান সরোয়ারের আমলে মাসের পর মাস বকেয়া বেতনের ঝক্কি পোহাতে হয়েছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নতুন নির্বাচিত মেয়র হিসেবে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের সময়ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চার মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া ছিল। পূর্ববর্তী প্রায় সব মেয়রই শত শত কোটি টাকার দেনা নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দায়িত্ব ছাড়ার সময় কয়েকশ’ কোটি টাকার দেনা রেখে যেতেন। সাদিক আব্দুল্লাহও তিনশ’ কোটি টাকা দেনার ভার মাথায় নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বিসিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস জানান, আগে স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের চেক যেতো ব্যাংক ম্যানেজারের নামে। অস্থায়ী কর্মচারীদের বেতনের চেক মেয়রের নামে ব্যাংক থেকে ক্যাশ করিয়ে নগদ দেয়া হতো। বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহনের পর তিনি আগের নিয়ম বন্ধ করে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নামে আলাদা ব্যাংক এ্যাকাউন্ট করে বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বপন কুমার বলেন, ব্যাংক এ্যাকাউন্টে বেতন যাওয়ার পর প্রায় এক হাজার অস্থায়ী ভুয়া কর্মচারীর সন্ধান মিলেছে। অথচ প্রতি মাসে ওই ভুয়া এক হাজার কর্মচারীর নামে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হতো। বছরে এর পরিমাণ সাড়ে আট কোটি টাকা। এ পর্যন্ত এই খাতে লোপাট অর্থের পরিমাণ কয়েকশ’ কোটি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিসাব বিভাগের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের আগে হিসাব বিভাগ থেকে প্রায় ২৬শ’ অস্থায়ী কর্মচারীর নামে বেতন হলেও এখন এক হাজার ৫২৩ জনে নেমে এসেছে। আগে এ খাতে প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হলেও এখন তা কমে দেড় কোটির কিছু বেশিতে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের জ্বালানি খাতেও হয়েছে সাগর চুরি। গত বছর ২৩ অক্টোবর সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি নগর ভবনের গাড়ি ব্যবহার করছেন না, এমনকি বেতন-ভাতাও নিচ্ছেন না। অথচ নতুন মেয়রের নামে জ্বালানি বরাদ্দের বিষয়টি কানে আসে তার। এর কিছুদিন পরই গাড়ির তেল চুরি করে বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা পরে একজন চালক। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করার পর এ খাতেও নতুন মেয়র নজর দিয়ে দ্রুতই ফল পেয়েছেন। গত দুই মাসে জ্বালানি তেল খাতে নগর ভবনের ব্যয় হয়েছে মাসে সাড়ে চার থেকে পৌনে পাঁচ লাখ টাকা। অথচ এ খাতে আগে মাসে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হতো। ট্রেড লাইসেন্স এবং হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়েও বিস্তার দুর্নীতি ধরা পরেছে নতুন মেয়রের কাছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর হোল্ডিং ট্যাক্স বিভাগকে নগরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য সংগ্রহ করতে বলেন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। একই সাথে তিনি নিজেও অনুসন্ধান শুরু করেন। পরে দেখা যায়, ট্রেড লাইসেন্স না করেই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছয় হাজারেরও অধিক। মাসোয়ারার বিনিময়ে তাদের ব্যবসার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। ফলে এ খাতে বছরে লোকসানের পরিমাণ ছিলো প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। হোল্ডিং ট্যাক্স বিভাগের অ্যাসেসর মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বর্তমানে বরিশাল নগরীতে ৫০ হাজার ৩৫০টি হোল্ডিং রয়েছে। সরকারী হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ৬৬২। বছরে এসব হোল্ডিং থেকে গড়ে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ট্যাক্স আদায়ের কথা। হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণেও দুর্নীতি ধরা পরেছে। চুরি, ঘুষ, তদ্বীর এবং সুপারিশের কারণে ট্যাক্স ফাঁকি ধরা পরেছে। বছরে ট্যাক্স ফাঁকির পরিমাণ প্রায় দশ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে নবাগত নির্বাচিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজ করতে গিয়ে দেখেছি খোদ নগর ভবনই দুর্নীতিগ্রস্থ। ভেতরে ভেতরে সবকিছু ফোকলা হয়ে গেছে। তাছাড়া সেবা পেতে যারা নগর ভবনে আসেন তাদের ঘুষ বাবদ গুনতে হচ্ছিল মোটা অঙ্কের টাকা। প্রথমে ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছি। নগর ভবন এখন ৯০ ভাগ ঘুষমুক্ত। তাছাড়া বেতন, জ্বালানি খাতের দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমার আগে যারা মেয়র ছিলেন তারা কি এসব দেখেননি? অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট হলেও তা কার্যকর নয়। ১৯৮৫ সালের পর এই নগরীতে আর কোনো ওভার হেড ট্যাঙ্কি হয়নি। কাগজে কলমে পানি সরবরাহের পরিমাণ দুই কোটি পাঁচ লাখ লিটার বলা হলেও সরেজমিনে আমি পেয়েছি মাত্র এক কোটি ৬০ লাখ। মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, বিগত পাঁচ বছরে নগরীতে এক ইঞ্চি পানি সরবরাহের লাইন বাড়েনি। সাতটি ওভারহেড ট্যাঙ্কির প্রায় সবই ব্যবহার অনুপযোগী। নগরীর জোয়ার-ভাটার খালগুলো ভরাট করে ড্রেন নির্মান করা হয়েছে। কোনো মাস্টারপ্লান নেই। প্রায় ১৬ বছরে নগর ভবনে নেই কোনো রেকর্ড রুম। সবমিলিয়ে যেন একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা। মেয়র বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করায় রাজস্ব আয় থেকে গত চার মাসেই বিসিসির কোষাগারে জমা হয়েছে সাত কোটি টাকারও বেশি। বিসিসির আয় থেকেও উন্নয়ন খাতে খরচ করা সম্ভব হয়েছে।