নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বাংলাদেশকে ঘিরে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নয়নে মাইলফলক স্থাপনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে দেশকে বদলে দিতে চান তিনি। ইতোমধ্যেই দেশের অবকাঠামোর ক্ষেত্রে একের পর এক বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার বড় অংশ এখন দৃশ্যমান। উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তদারকি করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মনিটরিং সেল। প্রয়োজনে বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করে খোঁজ নেয়া হচ্ছে প্রকল্পের। সারাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর ‘পায়রা’ এবং দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাসহ উপকূলীয় সাত উপজেলাকে ঘিরে গ্রহণ করা হয়েছে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা। ফলে সেভেন টাউনে পরিণত হতে যাচ্ছে বরিশাল বিভাগের সাত উপজেলা। এ মহাপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে আধুনিক পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপন, পরিকল্পিত নগরায়ণ, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষিখাতের উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং দুর্যোগ ঝুঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ভিত্তিক কার্যক্রম। উন্নয়নের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এজন্য গ্রহণ করেছে ‘পায়রা বন্দর নগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ-পর্যটন ভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’ প্রকল্প। যার আওতাভুক্ত বিভাগের সাত উপজেলা হচ্ছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী এবং বরগুনা জেলা সদর, আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা। পরিকল্পনা কমিশন এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। নগর উন্নয়ন অধিদফতরের জেষ্ঠ্য পরিকল্পনাবিদ শরীফ মোহাম্মদ তারিকুজ্জামানকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিয়ে গঠন করা হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন টিম। নগর উন্নয়ন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার এমবি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় রাঙ্গাবালীর সোনারচরকে বিদেশী পর্যটকদের জন্য এক্সক্লুসিভ পর্যটন কেন্দ্র করে গড়ে তোলা এবং কুয়াকাটা, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলা সমন্বয়ে পর্যটন জোন স্থাপনের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্র“য়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব সুরাইয়া বেগমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একসভায় পায়রা বন্দরসহ উপরোক্ত সাত উপজেলাকে ঘিরে দূরদর্শী মহাউন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২৭ সদস্যের সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই সমন্বয় কমিটির দ্বিতীয় সভায় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যেসব প্রত্যাশী সংস্থার অনুকূলে জমি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার ও নগর উন্নয়ন অধিদফতরকে। সূত্রে আরও জানা গেছে, পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে পাশ্ববর্তী এলাকায় নগরায়ণসহ ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে। নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে উঠবে। ফলে প্রকল্পভুক্ত অঞ্চলের ভূমি ব্যবহারের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে এবং বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সে কারনে প্রকল্প এলাকার বর্ধিত বিপুলসংখ্যক মানুষের বাসস্থান, স্কুল, কলেজ, বিনোদনসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে কৃষিজমির ওপর চাঁপ সৃষ্টি হবে। এছাড়া প্রকল্প এলাকাটি ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, নদীভাঙনসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যা উন্নয়ন মহাপরিকল্পনাকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, কৃষিজমি সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূরীকরণসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প। প্রকল্পের পরিচালক নগর উন্নয়ন অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ পরিকল্পনাবিদ শরীফ মোহাম্মদ তারিকুজ্জামান বলেন, এ প্রকল্প এলাকায় আগামী ২০ বছর পর্যন্ত সরকারের যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা আছে সেগুলো নিয়ে ভৌত অবকাঠামো পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর সাত উপজেলার জন্য গঠন করা হবে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ওই কর্তৃপক্ষের তত্তাবধানে বাস্তবায়িত হবে এই মহাউন্নয়ন পরিকল্পনা। প্রকল্প পরিচালক শরীফ মোহাম্মদ তারিকুজ্জামান বলেন, এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং পায়রা সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে একটি আধুনিক বন্দর নগরী গড়ে তোলা। উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিবেশবান্ধব সমুদ্র বন্দর গড়ার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে কুয়াকাটার উপকূলীয় অঞ্চলকে মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করে উপকূলের প্রান্তিক জনসাধারণকে তুলে ধরার জন্য উপকূলীয় পরিবেশকে বাস উপযোগী করে গড়ে তোলা। নগর উন্নয়ন অধিদফতরের বরিশালস্থ জ্যেষ্ঠ পরিকল্পনাবিদ মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, উপকূলীয় ওই সাত উপজেলা ও ছয়টি পৌরসভাজুড়ে বিস্তৃত নগরাঞ্চল গঠিত হবে এবং আশপাশের এলাকায় আধুনিক নাগরিক সুবিধাদি গড়ে উঠবে। পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে আধুনিক বন্দর নগরীর পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত নাগরিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা ও কুয়াকাটায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গঠন এবং পায়রা বন্দর এলাকায় আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান থাকবে এই প্রকল্পে। পায়রা-কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে আঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা হবে। প্রকল্পের আওতায় আমতলী-বরগুনা সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে পায়রা নদীর ওপর এবং বরগুনা-পাথরঘাটা যোগাযোগ স্থাপনে বিষখালী নদীর ওপর উপযুক্ত স্থানে সেতু নির্মিত হবে। প্রকল্প এলাকার সম্ভাবনাময় তিন ফসলি ও দুই ফসলি জমি চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণ করা এবং পায়রা বন্দরের কাছাকাছি উপযুক্ত এলাকায় অর্থনৈতিক জোন ও শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। ফলে উপকূলীয় এলাকার পিছিয়ে পরা খাতগুলো জাতীয় অর্থনীতির মূল ধারার সঙ্গে সংযুক্ত হবে। নগর উন্নয়ন অধিদফতর বরিশালের পরিকল্পনাবিদ মোঃ বায়েজীদ জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে পায়রা বন্দরের নিকটবর্তী অঞ্চলে একটি আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন, রাঙ্গাবালীর সোনারচরে বিশেষায়িত টুরিস্ট জোনসহ অন্য আকর্ষণীয় স্থানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযুক্ত পর্যটন ও নাগরিক সুবিধাদি গড়ে উঠবে। পাথরঘাটা, আমতলী, তালতলী, চরতুফানী, জাহাজমারা প্রভৃতি পর্যটন এলাকাকে সমন্বিত সমুদ্রভিত্তিক পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় আনা হবে। এ উন্নয়ন মহাকর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে ‘পায়রা বন্দর নগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ পর্যটন ভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক এক কর্মশালা সম্প্রতি বরিশাল সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বরিশালের বিভাগীয় কমিশনারের দফতর এবং নগর উন্নয়ন অধিদফতর এ কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার রাম চন্দ্র দাস এ মহাউন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত এলাকায় আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য এক হাজার ২০০ একর জমি বরাদ্দ রাখার ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ডেল্টা প্ল্যানের দিক নির্দেশনা নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্মশালায় অংশ নেয়া উপকূলীয় আমতলী, তালতলী ও কলাপাড়ার জনপ্রতিনিধিরা বলেন, আমতলী ও কলাপাড়ার মধ্যবর্তী যেকোন স্থানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করা যেতে পারে। ওই এলাকায় পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যাবে। পর্যটন কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) জাকির হোসেন কর্মশালায় বলেন, কলাপাড়া উপজেলায় পর্যটন বিকাশের জন্য ২৯৮ একর জমি বরাদ্দ চেয়ে তারা চিঠি দিয়েছিলেন। ওই জমি যাতে দ্রুত পর্যটন কর্পোরেশন পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বরগুনার জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদ বলেন, পর্যটন বিকাশে বরগুনায় অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জেলার ট্যাংরাগিরি, সোনাকাটা ও হরিণবাড়িয়া পর্যটনকেন্দ্র এ প্রকল্পের আওতায় নেয়া প্রয়োজন। কর্মশালায় এ প্রকল্পের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে সেভেন টাউনে পরিণত হতে যাওয়া সংশ্লিষ্ট সাত উপজেলায় পৃথক শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।