বিডি ক্রাইম ডেস্ক, বরিশাল॥ মা-ইলিশ রক্ষায় সরকার গত ৩ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ইলিশ ধরা, বিক্রি, পরিবহন ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। তবে বরিশালের বিভিন্ন নদ-নদীতে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যত উপেক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে মেঘনা নদীর ২২ কিলোমিটার অংশসহ বরিশালের নদীতে ইলিশ শিকারের ‘উৎসব’ চলছে। বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী বাজার বসিয়ে চলছে ইলিশের অবৈধ বেচাকেনা।
হিজলা ও অন্যান্য উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা না করার। বিশেষ করে হিজলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম ও বানারীপাড়া উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন রজনীর বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে, তারা নির্দিষ্ট এলাকায় অভিযানের বাইরে রাখার জন্য প্রভাবশালীদের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। এতে মেঘনা নদীর অন্তত ১০ কিলোমিটার এবং সন্ধ্যা নদীর কিছু অংশ অভিযান থেকে বাইরে রয়েছে।
মৎস্য দপ্তর সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের তিন জেলাসহ ছয় জেলায় মোট ৪৩২ কিলোমিটার নদী এলাকায় মা-ইলিশ আহরণে এই নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। এই সময়ে সব প্রজাতির মাছ আহরণ, পরিবহন, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণ বন্ধ থাকা উচিত। তবে বাস্তবে অভিযান যথেষ্ট কার্যকর হচ্ছে না।
অভিযানকালে সাত দিনে বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি আভিযানিক দল জেলেদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। জেলাজুড়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় নদীতে রাতের অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে হাজার হাজার জেলে ছোট-বড় ট্রলার নিয়ে রাত-দিন জাল দিয়ে ইলিশ শিকার করছেন।
হিজলা উপজেলার স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। ওই সিন্ডিকেটের নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে অভিযানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। দিনে দুবার, প্রতিবার দুই থেকে তিন ঘণ্টা সকাল ও বিকেলে অভিযান হলেও মেঘনা নদীর হিজলা অংশ এবং শাখা নদীতে মা-ইলিশ নিধন চলছে অব্যাহত।
হিজলার মেঘনা নদীর তীরগুলো কমপক্ষে অর্ধশত মাছঘাট উপজেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে। ওই সঙ্গে জেলেরা মাছঘাট মালিকদের চাপের কারণে নিষিদ্ধ সময়ে শিকারে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতি বছর হিজলা অংশে ১০ থেকে ১৫টি স্পিডবোর্ড ও ২০ থেকে ২৫টি ইঞ্জিন ট্রলার দিয়ে অভিযান চালানো হতো। কিন্তু এ বছর শুধু দুটি স্পিডবোর্ডে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এতে নদীর অধিকাংশ অংশ অভিযানমুক্ত রয়েছে।
বানারীপাড়া উপজেলার স্থানীয়রা জানান, সাত দিন পার হলেও উপজেলা মৎস্য বিভাগের উদ্যোগে সন্ধ্যা নদীতে তেমন কোনো অভিযান দেখা যায়নি। দিন-রাত সমান তালে জেলেরা ইলিশ শিকার করে নদীর তীরে বিক্রি করছেন।
মেহেন্দীগঞ্জের মেঘনা নদী, কালাবদর, তেঁতুলিয়া নদী, বাবুগঞ্জের আড়িয়াল নদ, সুগন্ধা ও সন্ধ্যা নদী, বানারীপাড়ার নান্দুহার ও বিশারকান্দি নদী, বাকেরগঞ্জের তুলাতলী, শ্রীমন্ত, কারখানা, তেঁতুলিয়া, বিষখালী, পায়রা, পান্ডব, গোমা, রাঙ্গাবালিয়া ও খয়রাবাদ উজিরপুর উপজেলার নদীর অংশেও ঢিলেঢালা অভিযান চলছে। এতে দিন-রাত এসব নদীতে মা-ইলিশ শিকার অব্যাহত রয়েছে।
অভিযোগ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ফোন কেটে দিয়েছেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা পলাশ কান্তি ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছরের অভিযান জোরদার করা হয়েছে। তবে অভিযানের শুরুতেই জেলেদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। যেটা আগে দেখা যায়নি। তাই অনেক কিছু বিবেচনা করে অভিযান চালাতে হয়। জনবল ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে ইলিশ রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেঘনা নদীর ২২ কিলোমিটারসহ বিশাল জলধারার এলাকার নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আমরা যেদিকে অভিযান করি, জেলেরা অন্যদিকে ইলিশ শিকার শুরু করে দেন। দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রমাণ সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানানো হয়েছে, ৯ অক্টোবর পর্যন্ত বরিশালে ৭৫০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় ২৫১টি মামলা হয়েছে। ১৪৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১৬৯ জেলেকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ৫ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩ লাখ ১১ হাজার ৮০০ টাকার জব্দ করা সরঞ্জাম নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। ৩ লাখ ২২ হাজার টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ৯০০ মিটার জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে।