• ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

বরিশালে ওষুধ কোম্পানির বর্জ্যে দূষিত কীর্তনখোলা

বিডিক্রাইম
প্রকাশিত অক্টোবর ২, ২০২২, ১৭:৫০ অপরাহ্ণ
বরিশালে ওষুধ কোম্পানির বর্জ্যে দূষিত কীর্তনখোলা

বিডি ক্রাইম ডেস্ক, বরিশাল ॥ নগরীর কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী কীতর্নখোলা নদী। ঐতিহ্যবাহী এই নদীর আটটি পয়েন্টে ১০ ওষুধ তৈরি কারখানাসহ বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য ঢালা হচ্ছে।

ফলে ধীরে ধীরে দূষণের কবলে পড়ছে এই স্রোতস্বিনী। দুই পাড়ে থাবা বসিয়েছে প্রায় চার হাজার ৩২০ দখলদার। গত দুই যুগে এই নদী রক্ষায় আন্দোলন করছেন পরিবেশবাদীরা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সাল থেকে দখলদারদের তালিকা প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে বিআইডব্লিউটিএ। যদিও সেই তালিকা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ কীর্তনখোলা নদী। এই নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে হাজারো পরিবার। নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ, বন্যা থেকে রক্ষাসহ এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কীর্তনখোলা নদীর গুরুত্ব অপরিসীম।

তবে দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এ নদী। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীর দুই তীর দখল করে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছে বহু স্থাপনা। আবার নগরীর ছয়টি পয়েন্টে ১০টি ওষুধ কোম্পানির বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে এ নদীতে।

এতে বিষাক্ত হয়ে পড়ছে এ নদীর পানি। সম্প্রতি বরিশাল নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলন এক জরিপে নগরীসংলগ্ন আটটি পয়েন্টে নদী দখল এবং দূষণের চিত্র পাওয়া গেছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর পর কীর্তনখোলা নদী হারিয়ে যাবে।

শুধু নদীবন্দর এলাকাই নয়, নগরীসংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর আটটি পয়েন্টে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষণ করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। নগরীর প্রবহমান ২৪টি খাল দূষণে নালা হয়ে গেলেও সেগুলো দিয়ে নগরীর সব বর্জ্য-ময়লা আর বড় ছোট কলকারখানার সব রাসায়নিক বর্জ্য মিশছে কীর্তনখোলা নদীতে।

বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসক সভাকক্ষসহ বিভিন্ন স্থানে শিল্পদূষণ, পরিবেশ বিপর্যয় ও জনদুর্ভোগ নিরসনে নিয়ে আলোচনা সভা ও সেমিনারে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তাদের দাবি, এমনটা চলতে থাকলে কীর্তনখোলার পানি ঢাকার বুড়িগঙ্গার মতো অবস্থা হবে।

কয়েক দশক ধরে চেষ্টার পরও ওষুধ কারখানাগুলো নগরীর বাইরে স্থানান্তর না হওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে পরিবেশবাদীদের মাঝে। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফিলতি।

তারা শুধু কারাখানা কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়ার মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। আজ পর্যন্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কারাখানা পরিদর্শনে যাওয়ার আগে রহস্যজনকভাবে বন্ধ থাকা ইটিপিগুলো চালু হয়ে যায়। এসব কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত বছর ৬ আগস্ট অপসোনিন কেমিক্যালের এবং ২৫ জুলাই গ্লোবাল ক্যাপসুলের তরল বর্জ্যরে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

এতে যে মাত্রা পাওয়া গেছে তা সবই নদীর জলজ প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্যের সহনীয় মাত্রার বাইরে। অপসোনিনের এ দুটি কারখানার বর্জ্য শোধনাগার বিধিমতো স্থাপিত হয়নি। সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে উল্লেখ রয়েছে, তরল বর্জ্যরে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে প্রতি লিটারে ৪ দশমিক ৫ থেকে ৮ মিলিগ্রাম। অপসোনিন কেমিক্যাল কারখানার নির্গত তরল বর্জ্যে আছে ৪ দশমিক ১ মিলিগ্রাম। সিওডি’র অক্সিজেন চাহিদার সহনীয় মাত্রা ২০০ মিলিগ্রাম হলে নির্গত বর্জ্যে আছে ২১০ মিলিগ্রাম। আবার দপদপিয়া গ্লোবাল ক্যাপসুলের বর্জ্যরে দ্রবিভূত অক্সিজেনের মাত্রা আছে ৩ দশমিক ২ মিলিগ্রাম। সিওডি’র মাত্রা ২৪৮ মিলিগ্রাম।

পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সমন্বয়ক লিংকন বায়েন বলেন, ওষুধ কারখানার বর্জ্য কীর্তনখোলা নদীতে পড়ছে। এসব কারখানা নগরীর মধ্য থেকে বহু বছর আগেই সরে যাওয়ার কথা থাকলেও বহাল থেকে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। নগরবাসীর একটাই প্রশ্ন, এসব কারখানা নগরী থেকে কবে অপসারিত হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা সমন্বয়কারী মো. রফিকুল আলম বলেন, নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খাল এবং কীর্তনখোলা নদী দূষণের জন্য বরিশালের কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানা এগিয়ে রয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চাপের মুখে এসব কারখানায় ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) স্থাপন করা হলেও সেগুলো নিয়মিত চালু রাখা হয় না। কারখানা থেকে রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি খাল ও কীর্তনখোলায় ফেলা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের টিম যেদিন পরিদর্শনে যায়, সেদিন ইটিপি চালু রেখে সবকিছু ঠিকঠাক দেখানো হয়।

কীর্তনখোলা নদীর তীর ঘুরে দেখা গেছে, যে যার মতো করে এই নদী দখল করে নিয়েছে। কেউ নদীর পাড়-সীমানা দখল করে গড়ে তুলছে বিভিন্ন স্থাপনা, কেউ আবার নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলছে ইট, বালু, পাথর ও কয়লা বিক্রির ডিপো ও লঞ্চ তৈরির ডকইয়ার্ড। আইনানুযায়ী, নদীর দুই তীরের যে অংশ শুষ্ক মৌসুমে চর পড়ে এবং বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়, তাই হচ্ছে ফোরশোর।

ওই ফোরশোর এলাকায় কারও অধিকার থাকে না। কেউ এই জমি দখল করলে তিনি দখলদার হিসাবে চিহ্নিত হবেন। এ বিধিভঙ্গ করে কীর্তনখোলা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে ওঠা রসুলপুর চর, মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠি চর, পলাশপুর চর, খোন্নারের চর, চরবাড়িয়ার চর এবং দপদপিয়া ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকা দখল করেছেন প্রভাবশালীরা। তবুও কীর্তনখোলার তীর দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬০ সালে নৌবন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য কীর্তনখোলা নদীর তীরের ৩৬ দশমিক ৮০ একর জমি বিআইডব্লিউটিএর অনুকূলে হস্তান্তর করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু ৫৬ বছরেও সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে অধিকাংশ সম্পত্তি নামে-বেনামে দখল করে নেন প্রভাবশালীরা।

নৌবন্দরের উত্তর দিকে জেল খালসহ রসুলপুর এলাকায় ২৮ একরের মধ্যে ২০ একর বেদখল হয়ে আছে। বরিশাল নৌবন্দরের উত্তরে আমানতগঞ্জ খাল থেকে দক্ষিণের রূপাতলী সিএসডি গোডাউনের খালের দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলার তীর বিআইডব্লিউটিএ’র।

বাকি অংশ জেলা প্রশাসনের। তবে বন্দরসংলগ্ন নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরে উচ্চ জলরেখা থেকে তীরের দিকে ৫০ গজ পর্যন্ত উভয় তীরে ৩৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ফোরশোর রয়েছে। যার অর্ধেকই বেদখলে চলে গেছে।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে কীর্তনখোলার তীর দখলকারী চার হাজার ৩২০ জন অবৈধ দখলদারের খসরা একটি তালিকা তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ১০ একর ৮২ শতাংশ জমি পুরোপুরি হাত ছাড়া হয়ে যায় বিআইডব্লিউটিএ’র।

এ ছাড়া পোর্ট রোডের মৎস্য আড়ৎসংলগ্ন এলাকার কয়েক একর জমি মৌজার নাম পরিবর্তনের কারণে বেদখলে রয়েছে। একইভাবে ১ একর ২৭ শতাংশ জমির উপরে বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধা পার্ক স্থাপন করে বরিশাল সিটি করপোরেশন। যদিও বিআইডব্লিউটিএ’র দাবি পার্ক নির্মাণ হলেও এই জমি তাদের দখলে রয়েছে। এ ছাড়া ২ একর ৫৭ শতাংশ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে তারা দাবি করেছেন।

বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের নৌবন্দর ও পরিবহণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, নদীর জায়গা উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে জরিপ করা হয়েছে। এরপর করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল পরবর্তী কার্যক্রম। তবে সম্প্রতি আমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এক মিটিংয়ে বলেছি এই দুই বছরে নতুন করে আরও কিছু দখলদার দখল দিয়ে বসেছে। তাদের তালিকায় হালনাগাদ করে নতুন তালিকা বানানোর প্রস্তুতি চলছে। সেটা হলে আমরা উচ্ছেদ অভিযানে যেতে পারব।

সম্প্রতি বরিশালে নৌবন্দর পরিদর্শন শেষে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বলেছেন, নদ-নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনাসহ অবৈধ দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে নদীনালা খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, ইতোমধ্যে আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, বিভিন্ন কলকারখানার মালিকদের সাথে বৈঠক করেছি। বিআইডব্লিউটিএ’র সঙ্গেও বসেছি।

তারা চাইলে আমরা অভিযান চালিয়ে বন্ধ ও দখল মুক্ত করতে পারি। আমরা ওষুধ কারখানাগুলোকে ইটিপি চালুর জন্য বলেছি। কিন্তু তারা নামমাত্র চালু রাখছে। আমরা গেলেই এটি চালু হয়, আবার বন্ধ হয়ে যায়। প্রয়োজনে আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এটি সচেতনতার বিষয়। তারা সবাই সরকারের কাছে দায়বদ্ধ, পরিবেশ সুরক্ষায় রেখে উৎপাদন করবে।