• ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩১শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২২শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

দক্ষিণের ৯ আসনে এগিয়ে ক্ষমতাসীন দল

admin
প্রকাশিত ডিসেম্বর ২২, ২০১৮, ১৮:১৬ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দক্ষিনের ২১ নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ৭টিতে প্রায় কখনোই হারেনি আওয়ামী লীগ। বাকি ১৪টির মধ্যে ৫টিতে জয়ের পাল্লা প্রায় সবসময় ভাড়ি ছিল বিএনপি’র। এছাড়া ৯টি আসন একেক সময় গেছে একেক দলের ঝুলিতে। এসব আসন বলতে গেলে কখনোই ছিলনা কোন একক দলের দখলে। এবারের নির্বাচনে এসব আসনে কি ঘটবে তা এখনই বলা সম্ভব না হলেও দলীয় নেতা-কর্মীদের মতে এই অঞ্চলের ৮টি আসনে এবার ভোটযুদ্ধের লড়াকু প্রার্থী দিতে পারেনি বিএনপি। এরমধ্যে এমন অন্ততঃ ৩টি আসন রয়েছে যেগুলোতে প্রায় সব নির্বাচনেই জিতেছে দলটি। কিন্তু এবার মনোনয়নের এই ভুলে শেষ পর্যন্ত কি হবে তা বলা মুশকিল। নির্বাচনী রাজনীতির হিসেবে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৪টি জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই ৪টি নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের ফলাফল বিশ্লেষনে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় থাকা ২১টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ৭টিকে ধরা হয় আওয়ামী লীগের ঘাটি। এগুলো হচ্ছে বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া), ভোলা-২ (বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান), বরগুনা-১ (বরগুনা সদর-আমতলী-তালতলী), পটুয়াখালী-২ (বাউফল), পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা), পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) এবং পিরোজপুর-২ (ইন্দুরকানী-ভান্ডারিয়া-কাউখালী)। এরমধ্যে পিরোজপুর-২ আসনটিকে সরাসরি আওয়ামী লীগের না বলে মহাজোটের বলা যেতে পারে। কেননা এখানে সবসময় জয়ী হয়েছেন মহাজোটের অংশিদার দল জেপি (মঞ্জু)’র প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ৯১ পরবর্তি ৪টি নির্বাচনের মধ্যে ৩টিতেই বরিশাল-১ আসনে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০০১’র নির্বাচনে একবার বিএনপি জিতলেও ভোটের ব্যবধান খুব একটা ছিলনা। ভোলা-২ আসনে বিএনপি ১ বার জিতলেও বাকী ৩ বারই এটি গেছে আওয়ামী লীগের দখলে। বরগুনা-১ আসনে সবকটি নির্বাচনেই জিতেছে আওয়ামী লীগ। একইভাবে পটুয়াখালী ৩ এবং ৪’এ জিতেছে দলটি। পটুয়াখালী-২ আসনে এই ৪টি নির্বাচনের ৩টিতেই আওয়ামী লীগের কাছে হারতে হয় বিএনপিকে। বরিশাল অঞ্চলের যে ৪টি আসনে বারবার জিতেছে বিএনপি তার মধ্যে অন্যতম বরিশাল-৫ (সদর)। এই আসনে কোন নির্বাচনেই পরাজিত হয়নি দলটি। এছাড়া বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী), বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ)’এ ৩ বার করে জিতেছে তারা। ২০০৮’র নির্বাচনে বরিশাল-৩ আসনে ধানের শীষ ৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারলেও সেবার এই আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোট যুদ্ধে নেমে প্রায় ২১ হাজার ভোট পান এবারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাড. জয়নুল আবেদীন। ভোলা-৩ (লালমোহন-তজুমদ্দিন) আসনে ৯১ পরবর্তি ৪টি নির্বাচনের ৩টিতে জয় পায় বিএনপি। এছাড়া ২০০৮’র নির্বাচনে জিতলেও এর আগে অনুষ্ঠিত ৩টি নির্বাচনেই ঝালকাঠী-২ আসনে বর্তমান ক্ষমসতাসীন দলের অবস্থান ছিল তৃতীয়। আর এসব নির্বাচনের মধ্যে ২ বার এই আসনে জিতেছে বিএনপি। উল্লেখিত ১১টি আসনের বাইরে থাকা ১০টি আসনে কখনোই এককভাবে জয় ধরে রাখতে পারেনি কোন দল। বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে জিতেছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ। বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনে ২বার বিএনপি ১বার আওয়ামী লীগ এবং ১বার জাতীয় পার্টি। ভোলা-১ (ভোলা সদর) আসনে ২বার বিএনপি ২ বার আওয়ামী লীগ। ভোলা-৪ (চরফ্যাশন-মনপুরা) আসনে ২বার বিএনপি ২বার আওয়ামী লীগ। বরগুনা-২ (বেতাগী-বামনা-পাথরঘাটা) আসনে একবার স্বতন্ত্র, একবার ইসলামী ঐক্যজোট, একবার বিএনপি এবং একবার আওয়ামী লীগ। ঝালকাঠী-১ (রাজাপুর-কাঠালিয়া) আসনে ১বার আওয়ামী লীগ, ১বার জাতীয় পার্টি এবং ২বার বিএনপি। ঝালকাঠী-২ (ঝালকাঠী সদর-নলছিটি) আসনে ২বার বিএনপি ১বার জাতীয় পার্টি এবং ১বার আওয়ামী লীগ। পটুয়াখালী-১ (সদর-মির্জাগঞ্জ-দুমকী) আসনে ২বার বিএনপি এবং ২বার আওয়ামী লীগ। পিরোজপুর-১ (পিরোজপুর সদর-নাজিরপুর-স্বরুপকাঠী) আসনে ২বার জামায়াত ২বার আওয়ামী লীগ এবং পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনে ১বার করে বাকশাল, জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ। প্রতীক বরাদ্ধ এবং আনুষ্ঠানিক প্রচার প্রচারনা শুরু হওয়ার পর বরিশাল অঞ্চলের ২১টি নির্বাচনী এলাকার এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে ৯টি আসনে কঠিন লড়াই হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের মধ্যে। এই আসনগুলো হচ্ছে বরিশাল-২ ও ৩, ঝালকাঠী-১, পিরোজপুর-৩, বরগুনা-১, পটুয়াখালী-১ ও ৪ এবং ভোলা-৩। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব আসনে প্রায় কখনোই এককভাবে টানা জয় ধরে রাখতে পারেনি এই দুই দল। বিষয়টি এরকম যে একবার যদি বিএনপি জেতে তো পরেরবার আওয়ামী লীগ। আবার জাতীয় পার্টি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ভাগ বসিয়েছে এসব আসনে। পটুয়াখালী-৪ আসনটি সবসময় আওয়ামী লীগের ভোটের ঘাটি হিসেবে বিবেচিত হলেও দলীয় মনোনয়ন প্রশ্নে এবার এখানে খানিকটা এগিয়ে আছে বিএনপি। এমনটাই মনে করছেন সেখানকার সাধারন মানুষ। কলাপাড়া উপজেলার পাখিমারা বাজারের দোকানী আলম সিকদার বলেন, বর্তমান এমপি মাহবুব তালুকদারকে মনোনয়ন দেয়া হলে চোখ বুঝে জিতে যেত আওয়ামী লীগ। নতুন প্রার্থী মহিব্বুর রহমান মুহিব কতদূর কি করতে পারেন সেটাই দেখার বিষয়। ভোট যুদ্ধের জন্যে লড়াকু দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন প্রশ্নে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের অভ্যন্তরেও রয়েছে সঠিক প্রার্থী বাছাই করতে না পারার অভিযোগ। এই অভিযোগের কথা জানিয়েছেন বিএনপি’রই তৃনমূলের নেতা-কর্মীরা। দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে পড়ার ভয়ে নাম পরিচয় প্রকাশে অনীহা থাকা বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতার বক্তব্য অনুযায়ী, মনোনয়নের ভুলে অন্ততঃ ৯টি নির্বাচনী এলাকায় ভোটের আগেই হেরে আছে বিএনপি। তাদের বক্তব্যের রেকর্ডও রয়েছে যুগান্তর’র দপ্তরে। ভোলা-৪ আসনের একাধিক বিএনপি নেতা বলেন, ভোট চাইতে গেলেই ভোটারদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠে যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব যেমন ১০ বছর ধরে এমপি তেমনি বিএনপি’র প্রার্থী নাজিমউদ্দিন আলমও ১০ বছর এমপি ছিলেন। জ্যাকব যেখানে চরফ্যাশন-মনপুরায় এতো উন্নয়ন করেছে সেখানে আলম কি করেছে ? আমরা ভোটারদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনা। এখানে ক্লিন ইমেজের নতুন কাউকে মনোনয়ন দেয়া হলে বলতে পারতাম যে আমাদেরকে সুযোগ দিয়ে দেখুন। পটুয়াখালী-৩ নির্বাচনী এলাকার আওতাধীন দশমিনা উপজেলা বিএনপি’র একাধিক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের এমপি থাকাবস্থায় যে গোলাম মাওলা রনি আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন করেছে, মামলা হামলা করে আমাদের ঘরছাড়া করেছে। বাড়ি-ঘরে হামলা ভাংচুর করেছে তার জন্যে বিএনপি’র হয়ে ভোট চাওয়াটাই তো আমাদের কাছে সবচেয়ে কঠিন। এখানে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে লড়াই লড়াটা অনেক সহজ হত। পিরোজপুর-১ আসনের স্বরুপকাঠী উপজেলা বিএনপি’র এক নেতা বলেন, এটা ঠিক যে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এই আসনে পরপর ২বার এমপি ছিলেন। কিন্তু তখন তার বাড়ি ইন্দুরকানী উপজেলা ছিল পিরোজপুর-১’র অধীনে। কিন্তু বর্তমানে ইন্দুরকানী পিরোজপুর-২ নির্বাচনী এলাকায়। এই হিসেবে ইন্দুরকানী ৫৫ হাজার ভোটও চলে গেছে সেখানে। তাছাড়া পিরোজপুর-১ আসনে যুক্ত হয়েছে প্রায় দেড় লাখ ভোটারের স্বরুপকাঠী উপজেলা। সাঈদীপুত্র শামিম সাঈদীকে পিরোজপুর-২ আসনে মনোনয়ন দিয়ে পিরোজপুর-১ আসনে বিএনপি’র কাউকে মনোনয়ন দেয়া হলে দু’টি আসনেই জয়ের সম্ভাবনা ছিল ফ্রন্টের। বরিশাল-১ আসনের আগৈলঝাড়া উপজেলা বিএনপি’র প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, গত ১০ বছরে ১ দিনের জন্যেও দুই উপজেলা সদরে আসেননি দলীয় মনোনয়ন পাওয়া সাবেক এমপি জহিরুদ্দিন স্বপন। ওয়ান ইলেভেনে সংস্কারে যাওয়ায় দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশও কঠিনভাবে তার বিরুদ্ধে। তারউপর এই আসনে মনোনয়নের লড়াইয়ে থাকা প্রভাবশালী দুই বিএনপি নেতা আকন কুদ্দুসুর রহমান এবং ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান ও তাদের অনুসারী নেতা-কর্মীরা এখন পর্যন্ত সক্রিয় নন স্বপনের পক্ষে। ঝালকাঠী-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া জিবা আমীন খান’র ব্যাপারেও রয়েছে একই আলোচনা। নির্বাচনী এলাকার সাথে কোন যোগাযোগ না থাকার পাশাপাশি তার পিতা আখতার ব্যারিষ্টার’র মুক্তযুদ্ধকালীন সময়ে সরাসরি স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে এলাকায়। বরগুনা ২ আসনে বারবার দল বদল করা বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাড. খন্দকার মাহবুবকে বিএনপি’র মনোনয়ন দেয়া নিয়ে রয়েছে হতাশা। বরিশাল-৪ এবং ভোলা-১ আসনেও বিএনপি’র মনোনয়ন নিয়ে চরম ক্ষোভ আর অসন্তোষ রয়েছে তৃনমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। ভোলা সদর উপজেলা বিএনপি’র এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের জায়ান্ট নেতা তোফায়েল আহম্মেদ’র বিপরিতে বিএনপি’র এমন একজনকে প্রার্থী করা হয়েছে যার জিতে আসা কেবল মুশকিলই নয় প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। রাজনৈতিক জীবনের প্রায় কোন নির্বাচনে পরাজিত না হওয়া তোফায়েল’র বিপরিতে প্রার্থী নির্বাচন প্রশ্নে আরো হুশিয়ার হওয়া উচিত ছিল দলের। ২০০৮’র নির্বাচনে সারা দেশ জুড়ে যখন বিএনপি’র ভরাডুবি ঠিক সেই সময়ে বরিশাল-৪ আসনে জয়লাভ করেন বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপি’র সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ। কিন্তু এবার সেই মেজবাহ-কে মনোনয়ন দেয়নি দল। যাকে দেয়া হয়েছে তিনি আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে কেন এবং কোন যোগ্যতায় টিকবেন সেটাই প্রশ্ন হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জের বিএনপি নেতা-কর্মীদের। বিষয়টি নিয়ে দারুনভাবে হতাশও সবাই। ৯টি নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি’র মনোনয়ন প্রশ্নে ভুলের এই যে অভিযোগ সে বিষয়ে জানতে চাইলে দলের যুগ্ম মহাসচিব এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, এবারের নির্বাচন গনতন্ত্র পূনঃ প্রতিষ্ঠার নির্বাচন। ভোটের মাঠে আমরা সেই লড়াই লড়ছি। বিএনপি’র মতো একটি বড় দলে যেখানে মনোনয়ন প্রত্যাশী কয়েক হাজার সেখানে দলের অভ্যন্তরে মনোনয়ন না পাওয়ার দুঃখ থাকবেই। তবে এবার প্রার্থী নয় ধানের শীষ দেখে ভোট দেবে সবাই। এটাই আমাদের বিশ্বাস।