• ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ১১ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

চিরসখা হে, ছেড়ো না ছেড়ো না মোরে

বিডিক্রাইম
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৩১, ২০২০, ২১:১৩ অপরাহ্ণ
চিরসখা হে, ছেড়ো না ছেড়ো না মোরে

দিঠি হাসনাত

প্রতিটা সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধন বা সম্পৃক্ততা অনেক দৃঢ় থাকে। কিন্তু আমার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। বাবাকে নিয়ে লিখতে পারা কঠিন ব্যাপার আমার জন্য। একটা গল্প বলি: আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছি, ক্লাসও মাত্র শুরু করেছি আর থাকছি আবাসিক হলে, একদিন দুপুরে কয়েকজন বন্ধু মিলে ঢাকায় চলে আসি।

 

আর আমি হঠাৎ দুপুরে বাবার অফিসে গিয়ে হাজির হই। অপ্রত্যাশিতভাবে বাবা আমাকে দেখে কী যে একটা হাসি দিল। আর আমি সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ইংরেজি সাহিত্য আমার পছন্দের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই জাহাঙ্গীরনগরে থাকা চলবে না। বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে হবে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই।

 

প্রতিটা সন্তানের সঙ্গেই বাবা-মায়ের নিবিড় সম্পর্ক থাকে। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আত্মিক টানটা অনেক বেশি। কারণ আমার বাবা আবুল হাসনাত ভীষণ সংবেদনশীল মানুষ। খুবই নরম মনের মানুষ।

এখনকার সময়ে এতটা সংবেদনশীল হওয়া এবং মানবিক হওয়া অনেকটাই বিরল ব্যাপার। যার কারণে চলার পথে তাকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। অনেকেই তাঁর ভদ্রতা-বিনয়ের সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু নিজের মনন, মানবিকতাকে, সংবেদনশীলতাকে নষ্ট হতে দেননি।

 

অনেক বৈরী পরিবেশে, বৈরী মানুষদের মাঝে থেকেও কেমন করে নিজের এই গুণাবলিকে অক্ষুণ্ন রেখেছেন তা আমি ভাবলে অবাক হয়ে যাই। অনেকেই বাবাকে অনেক স্বল্পভাষী কঠিন মানুষ ভাবেন।

 

কিন্তু আমার কাছে, আমার মায়ের কাছে বা আমার মেয়ে শ্রেয়সীর কাছে বাবা অনেক কাছের, অনেক সহজ মানুষ। ছায়ার মতো আমাদের পুরো পরিবারকে আগলে রেখেছে। যে ছায়াটা নেই, আমরা এখনো ভাবতেই পারছি না।

 

হয়তো এখন আছে, থাকবে নানাভাবে আমাদের জীবনে। আমার জীবনে নান্দনিকতার পাঠ বাবার কাছ থেকে যে কত শিশু বয়স থেকে শুরু হয়েছে তা এখন বুঝতে পারি।

 

চিত্রকলা সংগ্রহ বাবার খুব প্রিয় একটা বিষয়, যা আমি বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি। আমি তখন খুব ছোট, বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কামরুল হাসান কাকার বাসায়। আমার এখনো মানে আছে তার ইজেলে তখন তিন রমণী সিরিজের কোনো ছবি আঁকছিলেন। বাসায় এসে আমি বাবার কাছে ছবি আঁকার জন্য ইজেল চেয়েছিলাম।

আর কামরুল হাসান কাকা, কাইয়ুম কাকার ছবি বাঁধানো নিয়ে যে আমাদের কত গল্প আছে। প্রতি মাসে আমি বাবার সঙ্গে সেই ছবি বাঁধাইয়ের দোকানে যেতাম। কোন ছবির সঙ্গে কোন ফ্রেম ভালো হবে, কোন মাউন্ট ভালো হবে তা বুঝতে শিখেছি অবচেতনভাবেই।

 

সেসব ছবি যখন টাঙানো হবে নতুন বাসায় সেই ছবিগুলো কী যত্ন করে বাবা টানিয়েছে। বাবার ভেতর নান্দনিক ভাবনাটা খুব সহজাত। তা সে পত্রিকার মেকআপই হোক, আর ছবি বাঁধাই হোক না কেন—এ ভাবনাটা বাবার সহজাত। তবে নিজেকে কীভাবে তৈরি করতে হয় তা বাবার কাছে শিক্ষণীয়। কীভাবে ভাষা সুন্দর সাবলীল করতে হবে বা কীভাবে সুন্দর বাচনে কথা বলতে হবে, কীভাবে নির্লোভভাবে নীতি নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচা যায় তা বাবা আমাকে শিখিয়েছেন।

 

বাবার বই সংগ্রহ, চিত্রকলা সংগ্রহ আর রেকর্ড সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ আমাকে সংগীত, চিত্রকলা, বই আর চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আর যখন আমি উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি তখন আমাকে কুদরতী রঙ্গী বিরঙ্গী, রাগ-অনুরাগ, ‘আমার কথা’ বইগুলো পড়তে বলল। আমাদের বইয়ের সংগ্রহ থেকে বইগুলো খুঁজে দিল।

আর বই পড়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিত বাবা। ছোটবেলায় আমার বন্ধুরা গল্পের বই পড়ার জন্য বকা খেত, আমি গল্পের বই পড়ার জন্য আরো বই উপহার পেতাম। গান শেখার ব্যাপারেও একই কথা।

ছোটবেলায় মা-বাবা রেওয়াজ করানোর জন্য কত উপহার দেয়ার কথা বলত। আরো পরে যখন অনেক গানের ভেতর ঢুকতে চাচ্ছি, রেওয়াজ করতাম, বাবা গান শুনে বলত করে যাও। শুধু বলত চুপচাপ রেওয়াজ করে যাও।

আমি যখন খুব ছোট, বাবার লেখা বইগুলো পড়ছি, ‘ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়’, ‘রানুর দুঃখ ও ভালবাসা’, ‘সমুদ্র ও টুকুর গল্প’; আমি অবাক হয়েছি যে বাবা কীভাবে একজন শিশুর মনোজগত বুঝতে পারছে।

একই ব্যাপার দেখেছি আমার মেয়ে শ্রেয়সীকে বড় করার ক্ষেত্রে আমার পারিবারিক জটিলতায় অনেক কিছু হয়তো আমার চোখ এড়িয়ে গেছে, কিন্তু বাবা শুধু আমাকে বলত যাই করো শ্রেয়সীর দিকটা সবকিছু ভেবে করবে। ওকে বেশি বকাঝকা করবে না।

 

সব সময় ওকে বন্ধুর মতো বুঝিয়ে বলবে। তোমাকে অনেক শক্তভাবে সংবেদনশীলভাবে শ্রেয়সীকে বড় করতে হবে। গত তিন বছর যখন নিউইয়র্কে আমাদের কাছে বেড়াতে এসেছিল এত ভালো সময় কেটেছে আমাদের।

এতকিছু করার ইচ্ছা ছিল, আর কত জায়গায় বেড়ানোর পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সেই ইচ্ছাটা অসম্পূর্ণই থেকে গেল। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যখন আশঙ্কা করছি এক ভয়াবহ সময় আসছে।

 

বাবাকে, মাকে শুধু বলেছি খুব সাবধানে থাকতে হবে, আমাদের সবার সাবধানে বেঁচে থাকতে হবে। আমার যখন এপ্রিল মাসে করোনা হলো বাবা-মাকে জানতে দিইনি। বাবা প্রতিদিন জিজ্ঞাস করেছে তোমার কী হয়েছে, গলাটা বসা কেন? আমি বলেছি ঘুমিয়েছি তো তাই। কিন্তু বাবা-মার আশঙ্কা কমেনি। বাবা শুধু ফোনে বলেছে, ভালো লাগে না, কাছের মানুষেরা চলে যাচ্ছে, কী হবে।

আমি কত বোঝালাম কিছু হবে না শুধু সাবধানে থাকতে হবে। এই সংকটময় সময় পার হলে আমরা একসাথে হব, আবার কলকাতায় যাব। কত বেড়াব নিউইয়র্কে আবার আমরা একসাথে। তা আর হলো না। এমনভাবে আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করবে, ঠিক আছো মা? আমার কষ্টে আর কেউ অস্থির হবে না। কেউ আর এমনভাবে আগলে রাখবে না।

 

আমার আর মায়ের পুরো পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে গেছে। দেশ থেকে দূরে থাকাতে আরো অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। এখন অনেক বেশি বুঝতে পারছি আত্মিক টান কতটা বাবার সঙ্গে। বিশাল কাজের জগতের মধ্যে অনেক পরিপূর্ণ জীবন বাবার। আমাদের ভালো রাখার জন্য কষ্ট করে গেছেন। পারিবারিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

অনেক লেখক-পাঠক তৈরি করাই ছিল তার ব্রত। সেই গুরুদায়িত্ব করতে গিয়ে নিজের লেখালেখির সময় পাননি অনেক বছর। যখন লেখালেখির কাজ গুছিয়ে এনেছেন তখনই যাওয়ার সময় হয়ে এল।

আর ষাট দশক থেকে ছায়ানটের সঙ্গে, সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। নালন্দা বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির লিয়াজোঁ অফিসের পুরো দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় মুক্তিযুদ্ধে সার্বক্ষণিক যুক্ত থেকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।

১৯৬৫ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য থেকেছেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি এভাবে নীরবে-নিভৃতে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করে গেছেন। ১৯৬৬ সাল থেকে বাবা ছায়ানটের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকেছেন। ষাটের দশক থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছায়ানট, সংস্কৃতি সংসদ, আফ্রো এশীয় লেখক ইউনিয়নসহ নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।

আইটিআইসহ (ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট) সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গেও সম্পৃক্ত থেকেছেন বহু বছর। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিষয়ে তাঁর আজন্ম আগ্রহকে শুধু তাত্ত্বিক চর্চায় সীমাবদ্ধ রাখেননি।

 

তাঁর সমগ্র জীবনচর্চায় তার প্রতিফলন রেখেছেন। যার ছাপ আমি দেখেছি সংবাদের সাহিত্য পাতায় প্রতিটা সংখ্যার পরিকল্পনা থেকে কালি ও কলমের প্রতিটা সংখ্যার পরিকল্পনা পর্যন্ত। তার প্রতিফলন দেখা যায় জীবনযাপনে, দর্শনে। ১৯৬৬ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংস্কৃতি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে থেকেছেন।

ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার শিল্পরুচির প্রতিফলন দেখেছি প্রতিটা কাজে, যা আমার চলার পথের পাথেয়। আজ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জ্ঞানী-গুণীজন ও সাহিত্যপ্রেমী পাঠক যারা তাঁকে স্মরণ করে আমাদের সমবেদনা জানাচ্ছেন ও তাঁর কাজকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন তাঁদের সবার প্রতি আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

 

আমি যখন শোকে স্তব্ধ তখন অনেকে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করেছেন, অনেকে শোক জানিয়েছেন। সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। পণ্ডিত তন্ময়বোস, তন্ময়দাদা আমায় ফোন করে বলেছেন, ‘তিনি এখন আরো জ্যোতির্ময়, আরো শক্তিশালী এবং তিনি তোর কাছেই আছেন।’ বাবা গত বছর আমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বলে গেছেন, আমি মার্চ-এপ্রিলেই তোমার আর শ্রেয়সীর কাছে আসব। তন্ময়দার কথা আমাকে শক্তি দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি বাবা আমার প্রতিটা চিন্তায়, প্রতিটা নিঃশ্বাসে মিশে আছে। এখন আরো বেশি করে হয়তো আমাদের কাছে এসে গেছে। তাই সারা দিন গেয়ে চলেছি—চিরসখা হে, ছেড়ো না ছেড়ো না মোরে।

দিঠি হাসনাত: সদ্য প্রয়াত কালি ও কলমের সম্পাদক, কবি ও লেখক আবুল হাসনাতের মেয়ে ও শিক্ষক