নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল আজকের দিনে পাকহানাদার বাহিনী বরিশাল আক্রমন করে । এদিন গৌরনদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকহানাদারবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করায় তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়, জ্বালিয়ে দেয় বাড়ীঘর। পাকবাহিনী এদিন চরবাড়ীয়ায় প্রায় ৫শজন সাধারন মানুষ এবং গৌরনদীতে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধসহ ২৫ জনকে হত্যা করেছিল। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও শহীদদের তালিকায় নাম উঠেনি অনেকের। পায়নি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। এমনকি তাদের নামগুলোও সংরক্ষন করা হয়নি। শহীদ পরিবারের সদস্যরা অনেকেই আজ অর্ধহারে অনহারে না খেয়ে মাববেতর জীবন যাপন করছে। এমনকি সংরক্ষন করা হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। নির্মান করা হয়নি কোন স্মৃতি ফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ। এ কারনে মুক্তিযোদ্ধারা আজ ক্ষুদ্ধ ও হতাশ। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকবাহিনী জল, স্থল ও আকাশ পথে বরিশাল আক্রমন করে। তারা ঢাকা থেকে সড়ক পথে বরিশাল আসার সময়ে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদীর কটকস্থল সাউদের ব্রীজের নিকটে পাকসেনাদের বাধা দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। পাকসেনাদের পরাস্থ করতে মেজর জলিলের পরিকল্পনায় কাশেম মাষ্টার ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনম আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের সরাসরি যুদ্ধে ৪জন মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন বক্স, মোক্তার হোসেন, সৈয়দ আবুল হাসেম ও পরিমল মন্ডল শহীদ হন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা বীরের ন্যায় যুদ্ধ করে ৮ পাক সেনাদের হত্যা করেছিল ও তাদের ২ টি গাড়ী ধ্বংশ করতে সক্ষম হন। পাকসেনাদের সাথে মুিক্তযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয় । এটিই ছিল দক্ষিনাঞ্চল পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সন্মুখ যুদ্ধ। পরে পাকবাহিনী গুলি করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ৩টি গানবোর্ডে নদী পথে বরিশাল আসার পথে পাকবাহিনী নগরী থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে জুনাহার নদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয় পাকসেনারা। মুক্তিযোদ্ধারা ইরানী ও মাজবী নামে দুটি জাহাজ দিয়ে নদীতে বেড়ীগেট দেয় এবং পাকবাহিনীর গান বোর্ডে গুলিবর্ষন করে। পাকবাহিনী বোমা মেরে জাহাজ দুটি ডুবিয়ে দেয় এবং চরবাড়ীয়া, তালতলী, চরমোনইসহ প্রায় ৬ টি গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকবাহিনীরা নরকীয় হত্যাকান্ড চালিয়ে প্রায় ৫শ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। বাড়ী ঘরে অগ্নিসংযোগ লুটপাট ও নারী নির্যাতন চালায়। দু একটি কবর ছাড়া বাকীদের কবর পর্যন্ত এখন খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তবে সেই সব শহীদদের স্মরন করতে তালতলীতে একটি স্মৃতিফলক নির্মান করেছে স্থানীয়রা। পাকসেনরা চরবাড়ীয়ায় আকাশ পথেও হামলা করে। পাকসেনারা যাকে যেখানে যেভাবে পেয়েছে তাকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করে । তাদের হাত থেকে শিশু, মহিলা এমনকি মসজিদের ইমাম পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। চরবাড়ীয়ার সর্বত্র এবং তালতলী নদীতে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। এরপর পাকবাহিনীরা তৎকালীন আ’লীগের সেক্রেটারী নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে হত্যার জন্য বরিশালে এসে জড় হয়। বরিশাল দখল করে সাগরদী পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে ঘাটি স্থাপন করে পাকবাহিনী। ঘাটির চারদিকে বাংকার স্থাপন করে পাহাড়া বসায়। পাকবাহিনী ৮ থেকে ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে এখানে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেয়। লাশের স্তুপে পরিনত হয় পুরো এলাকা। সাগরদীর এই এলাকা বদ্যভূমি নামে পরিচিত। অথচ এই শহীদদের নাম আজও সংরক্ষন করা হয়নি। এদিকে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও মুক্তিযদ্ধের এই স্মৃতিস্থান চিহ্নিত করে সংরক্ষন করা হয়নি। এ জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। স্মৃতি স্থান গুলো সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ফলক বা স্মৃতি স্তম্ভ নির্মানের দাবী জানিয়েছেন তারা। এদিকে ৩ কোটি টাকার বেশী ব্যায়ে নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের সামনে টর্চারসেল ও বাংকার সংরক্ষন কাজ শুরু হলেও তা নিম্ম মানের কাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দৈনিক দেশ জনপদ পত্রিকায় টর্চারসেল ও বাংকার সংরক্ষনে নিন্মমানের কাজ হওয়ায় প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে। পরবর্তীতে জেলা প্রসাশক ও মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর পদক্ষেপে সুষ্ঠভাবে কাজ পরিচালিত হয়। বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক কমান্ডার এনায়েত হোসেন চৌধুরী জানায়, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও বরিশালের মুক্তিযুদ্ধর স্মৃতিগুলো রক্ষা করা হয়নি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ স্থান আজও চিহ্নিত করে সংরক্ষন করা হয়নি। বরিশালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো জরুরীভাব সংরক্ষন করা না হলে অচিরেই তা হারিয়ে যাবে। এই স্মৃতিগুলো সংরক্ষনে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।