• ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

সীমাহীন অনিয়মে চলছে পায়রা বন্দর’র জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়ন প্রকল্প

admin
প্রকাশিত নভেম্বর ১৭, ২০১৯, ১৬:০৬ অপরাহ্ণ

 

পটুয়াখালী প্রতিনিধি॥
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা সমুদ্র বন্দরের জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। এ লক্ষ্যে কারিগরী ও টেকনিক্যাল বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহন করেছে সরকার। ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূয়র (ডরপ) বিভিন্ন মেয়াদের এ প্রশিক্ষন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। অথচ এসব প্রশিক্ষন কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং প্রশিক্ষিত দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে সরকারের মহতি উদ্দোগ বাধাঁগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কেউ জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রশিক্ষন নিয়ে কথা বলতে রাজী হননি।

সরেজমিনে কলাপাড়া শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে কার ড্রাইভিং কাম অটো মেকানিক প্রশিক্ষনে দেখা যায়, দু’টি ভাড়া মাইক্রো নিয়ে গোল চক্কর মারছে দুই জন। একটু দূরে দাড়িয়ে আছে আরও ১০/১২ জন। এক একজনকে এক/দুই চক্কর করে ড্রাইভিং শেখাচ্ছে দু’টি গাড়ীর ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে থাকা দুই কিশোর। তাদের কারোরই বিআরটিএ’র অনুমোদিত হালকা কিংবা ভারী যান চালনার লাইসেন্স নেই বলে জানা গেল আলাপচারিতায়। একটু পরেই মোটর সাইকেলে এসে হাজির হলেন আরও দু’জন। তাদের একজন ডরপ’র ডেপুটি টিম লিডার আর অপর জন কর্মকর্তা। এসময় টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউট’র দায়িত্ব প্রাপ্তকে কাছে দূরে কোথাও দেখা না গেলেও ডেপুটি টিম লিডার বললেন কার ড্রাইভিং’র দায়িত্বে আছেন তিনি।

জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রশিক্ষনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডরপ’র টিম লিডার জেবা আফরোজ বলেন, ’প্রথম মেয়াদের বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষন কোর্স সম্পন্ন করার দায়িত্বে ছিল পায়রা বন্দর কৃর্তপক্ষ, আমরা (ডরপ) সহযোগীতা করেছি। দ্বিতীয় মেয়াদের একাধিক ট্রেডের প্রশিক্ষন কোর্স বন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রানী সম্পদ, মৎস্য, যুব উন্নয়ন ও কৃষি অফিস সহ খেপুপাড়া ইসমাইল তালুকদার বিএম টেকিনিক্যাল ইনষ্টিটিউট’র সহায়তায় আমরা বাস্তবায়ন করছি।’ অথচ স্থানীয় যুব উন্নয়ন অফিসার বললেন, ’তিনি এ প্রশিক্ষনের বিষয়ে অবগত নন। মৎস্য ও কৃষি কর্মকর্তা বললেন, ’তারা কয়েকদিন একটি এনজিও’র আমন্ত্রনে পায়রা বন্দরে গিয়েছেন। তবে ক’দিন তা মনে নেই। ওই এনজিও’র কাগজে সন্মানী নেয়ার সময় স্বাক্ষর করেছেন। তারা বলতে পারবেন ক’দিন প্রশিক্ষন দিয়েছি।’ এছাড়া কার ড্রাইভিং, ওয়েল্ডিং সহ প্রশিক্ষন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউটটির অনুমোদন ও প্রশিক্ষক নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডরপ এ প্রশিক্ষন কার্যক্রম সম্পন্ন করার কাজে নিযুক্তী লাভ করে। প্রশিক্ষন কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং প্রশিক্ষিত দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করার কথা বললেন পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ’র উপসচিব ও যুগ্ম পরিচালক (এস্টেট) খন্দকার নূরুল হক।

জানা যায়, ২০১৮ সালে পায়রা বন্দরে জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ১১৩৪ সদস্য প্রথম ধাপের কার ড্রাইভিং, বেসিক কম্পিউটার, রাজমিস্ত্রী, উন্নত প্রযুক্তিতে হাঁস-মুরগী পালন ও খাদ্য তৈরি, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে পারিবারিক পরিমন্ডলে গাভী পালন, মৎস্য চাষ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ, ব্রয়লার, ককরেল ও টার্কি পালন, বসতবাড়ীতে সবজি ও ফলের চাষ, গরু মোটা তাজা করন, পশু পাখীর খাদ্য প্রস্তুত ও তৈরী ট্রেডে প্রশিক্ষন লাভ করে। ছয় মাস, তিন মাস, এক মাস ও ২১ দিন মেয়াদী এসব প্রশিক্ষন কাগজে কলমে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন দেখালেও প্রশিক্ষনার্থীদের মধ্যে মাত্র ৫/৭ জন ছাড়া অন্যরা দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে সফল ভাবে প্রশিক্ষন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেনি। তাই তারা তাদের প্রশিক্ষনলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কেউ স্বাবলম্বি হয়েছে এমন তথ্য জানা যায়নি। এরপর ৬৬৬ জনকে নিয়ে ২য় ধাপের প্রশিক্ষন শুরু করা হয় চলতি বছরের অক্টোবরে। ২য় ধাপের এ প্রশিক্ষনে বসতবাড়ীতে সবজি ও ফলের চাষ, পশু পাখীর খাদ্য প্রস্তুত ট্রেড দু’টি বাদ দিয়ে ছাগল পালন ও ওয়েল্ডিং অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

এদিকে প্রথম ধাপের প্রশিক্ষনে অংশগ্রহনকারী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কয়েক সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ অংশগ্রহনকারী সফল ভাবে প্রশিক্ষন সম্পন্ন করতে পারেন নি। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষকের দক্ষতা, উপস্থাপনা এবং হাতে কলমে প্রশিক্ষনের দুর্বলতা সহ অংশগ্রহনকারীদের বেশীর ভাগ টাকা পাওয়ার জন্য অংশ নিয়েছেন। তবে প্রতিদিন ৫০০ টাকা হারে সন্মানী দেয়ার কথা থাকলেও ভ্যাটের নামে টাকা কর্তনে সঠিক হিসাবের টাকা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন তারা। ২য় ধাপের বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষনে অংশগ্রহনকারীরা জানালেন, স্থানীয় দু’জন তাদের প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষন দিচ্ছেন। তারা কোন প্রতিষ্ঠানের আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নন। তাদের ক্লাসে অংশ নিয়েও ঠিকমত শেখা যাচ্ছেনা।

ডরপ’র টিম লিডার জেবা আফরোজ বলেন, ’পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রানী সম্পদ, মৎস্য, যুব উন্নয়ন ও কৃষি অফিস সহ খেপুপাড়া ইসমাইল তালুকদার বিএম টেকিনিক্যাল ইনষ্টিটিউট’র সহায়তায় আমরা সুষ্ঠু ভাবে প্রশিক্ষন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি।’

খেপুপাড়া ইসমাইল তালুকদার বিএম টেকিনিক্যাল ইনষ্টিটিউট’র অধ্যক্ষ ও সরকারী মোজাহার উদ্দীন বিশ্বাস কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক মো: আবু সালেহ বলেন, ’ডরপ’র অনুরোধে ওয়েল্ডিং ও কার ড্রাইভিং কাম অটো মেকানিক শর্ট কোর্সের জন্য খেপুপাড়া ইনষ্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি’র পক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন আনা হয়েছে। অসিম সিকদার নামের একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এ শর্ট কোর্সের শিক্ষক।’ তবে খেপুপাড়া ইনষ্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত অসিম সিকদার নামের ওই ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ’তিনি ইলেকট্রিক্যাল বিষয় দেখেন। অন্য বিষয় গুলো অধ্যক্ষ সালেহ সাহেব জানেন। শর্ট কোর্সের অনুমোদন সংক্রান্ত কাগজ পত্র, খাতা ঢাকায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।’

উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা জালাল আহমেদ বলেন, ’পায়রা বন্দরের কোন প্রশিক্ষনের বিষয়ে তিনি অবগত নন। এমনকি কখনও তাকে কেউ এ বিষয়ে জানায়নি।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আ: মন্নান ও মৎস্য কর্মকর্তা মনোজ কুমার সাহা বলেন, ’একটি এনজিও’র আমন্ত্রনে পায়রা বন্দরে কয়েকদিন তারা গিয়েছেন। তবে ক’দিন তা মনে নেই। ওই এনজিও’র কাগজে সন্মানী নেয়ার সময় তারা স্বাক্ষর করেছেন। তবে প্রশিক্ষন সংক্রান্ত কোন সিডিউল তারা সরবরাহ করেননি।’

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ’র উপসচিব ও যুগ্ম পরিচালক (এস্টেট) খন্দকার নূরুল হক বলেন, ’জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে প্রশিক্ষনের জন্য সরকার ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডরপ এ প্রশিক্ষন কার্যক্রম সম্পন্ন করার দায়িত্ব পেয়েছে।’
#