• ১২ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৭শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৮ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

ত্রুটিমুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা

বিডিক্রাইম
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৯, ২০২১, ১৪:৪১ অপরাহ্ণ
ত্রুটিমুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা

সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র হিসেবে সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতাসহ নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদান করে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক বা সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিমুক্ত তালিকা প্রস্তুতের কাজ সম্পন্ন করতে না পারা খুবই দুঃখজনক। এই তালিকার কার্যক্রম এমনই অগোছালো যেইতিমধ্যেই বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এক মুক্তিযোদ্ধার নাম নতুন করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকা’র যাচাই-বাছাই তালিকায় আবার আসা শুধুই পীড়াদায়ক নয়, লজ্জাজনকও বটে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন প্রয়াত এমপি আবুল হোসেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, গণপরিষদের সদস্য ছাড়াও সংবিধানে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকায় নতুন করে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু আবুল হোসেন নন, এ তালিকায় এ অঞ্চলের একমাত্র বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হকের নামও এসেছে। জানা যায়, জামুকার সুপারিশ ছাড়া যাদের নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বেসামরিক গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের নাম সংশোধন করে নতুন করে ৩৮ হাজার ৩৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়। যদিও গত ৯ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিত করে জামুকা। জামুকার তালিকা অনুযায়ী, ভারতীয় তালিকা বা লাল মুক্তিবার্তায় নাম আছে, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে ওই যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায়। এমনই দুজন হলেন লালমনিরহাটের প্রয়াত আবুল হোসেন ও আজিজুল হক।

অন্যদিকে, সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল তাদের পিএইচডি প্রোগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে প্রয়াত আবুল হোসেনের বীরত্বপূর্ণ অবদানের ওপর গবেষণা প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। আর ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক বীরপ্রতীক স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন। এই ব্যক্তিদের তো নতুন করে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা প্রমাণ করার অবকাশ থাকে না। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। প্রথমে মুক্তিযুদ্ধকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান আতাউল গনি ওসমানীর সইযুক্ত সনদ যাদের কাছে ছিল, তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। সেই সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজারের কাছাকাছি। ওসমানীর সইযুক্ত সনদের বাইরে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তা নিশ্চয়ই নয়। দেশের ভেতরে থেকেও অনেকে যুদ্ধ করেছেন, যারা ওসমানীর সইযুক্ত সনদ পাননি। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হলো, তখনই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বেশি বিতর্ক হলো। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা নানা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করলেন, যার মধ্যে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সচিবও ছিলেন। পরে সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় তাকে পদত্যাগ করতে হয়। এ রকম আরও অনেক অসাধু কর্মকর্তা ধরা পড়েছেন। আবার অনেকে এখনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব মুক্তিযোদ্ধার (গেজেটভুক্ত) বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে হিসেবে একজন মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হবে সাড়ে ৬১ বছর। গত বছরের অক্টোবরে সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করার সময়ে এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার তথ্য পেয়েছে, যাদের বয়স এই সময়সীমার চাইতে অনেক নিচে। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, এসব মুক্তিযোদ্ধার কারও জন্ম ১৯৮২ সালে, কারও আবার ১৯৯১ সালে। এমন প্রায় দুই হাজার জনের তথ্য পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাদের জন্ম (পরিচয়পত্রের তথ্যে) মুক্তিযুদ্ধের পরে।  এক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নের সময় অল্প কয়েকজনের জন্ম তথ্য ভুল হতে পারে, কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক ব্যক্তির জন্মসময়ের তারতম্য তালিকার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের তালিকার গেজেট প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আগের তালিকায় ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলে দাবি করে তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নেয়। সে সময় আরও সাড়ে ১১ হাজার ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয় সরকার।  কিন্তু ৭০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলে যে দাবি করা হয়েছিল তাদের সনদ বাতিল করা হয়নি। উল্টো সেই সময়ে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই ২০১৪ সালে ভুয়া প্রমাণিত হন। আমরা মনে করি, যারা প্রকৃতই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের কেউ তালিকা থেকে বাদ পড়ুন তা যেমন কাম্য নয়, তেমনি কোনো অমুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক বিবেচনায় তালিকাভুক্ত থাকবেন, তা-ও মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে ত্রুটিমুক্ত পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।