বিডি ক্রাইম ডেস্ক, বরিশাল ॥ গোলের গুড়ে বদলে গেছে বরগুনার তালতলীর বেহালা গ্রাম। এ গ্রামের বিলে আছে গোলপাতার ঝাড়। স্থানীয়ভাবে গোলঝাড়ের বাগানকে ’বাহর’ বলা হয়। প্রতিটি ঝাড় থেকে কয়েকটি ছড়া বের হয়। সেখান থেকে একটি রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলা হয়। ছড়ার শ্বাস তালের কচি শ্বাসের মত কেটে রস বের করা হয়। ওই রস থেকে উৎপাদন হয় গোলের গুড়।
প্রতি বছর শীত মৌসুমে গোল গাছিদের কর্ম ব্যস্ততায় বদলে যায় বেহেলা গ্রামের চিত্র। কাক ডাকা ভোরেই শুরু হয় গোলের রস। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গোলের রসের মৌ মৌ গন্ধ। পরে শুরু হয় গুড় তৈরির কর্মযজ্ঞ।
গোলগাছ লোনা পানিতে উৎপন্ন হয়। তাই গোলের গুড়ের স্বাদ একটু লবনাক্ত হয়। তবে তা স্বাদে প্রভাব ফেলে না। স্বাদে ও গন্ধে এ গুড় দারুণ। আখ ও খেজুরের গুড়ের চেয়েও গোলের গুড় বেশি সুস্বাদু। তাই স্থানীয় বাজারে গোলের গুড়ের চাহিদা অনেক। বাসা-বাড়িতে বিভিন্ন খাবারে গোলের গুড় ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি শীতের পিঠা ও পায়েস তৈরিতেও গোলের গুড়ের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে বেহালার গোলের গুড় এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রফতানি হচ্ছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন ভারতেও রফতানি শুরু হয়েছে।
নভেম্বরের শেষ থেকে মার্চের মাঝমাঝি সময় পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেন বেহালার গোলগাছিরা। এতেই জীবিকা চলে তাদের। গ্রামটিতে গোল গাছের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এছাড়া গোল গাছ আছে উপজেলার গেন্ডামারা গ্রামসহ আরো কয়েকটি গ্রামে। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০টি গাছের রস সংগ্রহ করতে পারেন। বর্তমানে রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন অন্তত দুই শতাধিক চাষি।
কেউ কেউ নিজের মালিকানাধীন গোল গাছগুলো অন্যজনকে বর্গা দেয়। প্রতিটি গাছের জন্য এত কেজি করে গুড় গ্রহণ করে।
জানা যায়, শীতের সময় গোল গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায়। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথেই রস সংগ্রহ শুরু হয়। এ সময় গাছিরা গাছ কেটে প্লাস্টিকের বোতল বসিয়ে রস সংগ্রহ করেন। শীত যত তীব্র হয়, রসের পরিমাণও তত বেড়ে যায়। রসের গুণগত মানও বৃদ্ধি পায়। শীতের এ কয়েক মাসে রস ও গুড় বিক্রি করে লাখ টাকাও আয় করেন একেকজন গাছি।
বেহালা গ্রামের গোল গুড় চাষী নিশিকান্ত শীল বলেন, ‘আমি ৩০০ গাছ বর্গা নিয়ে কাটি। এতে গড়ে ১২ থেকে ১৪ কলস রস পাই। প্রতি কলস রসে আড়াই থেকে তিন কেজি গুড় হয়। বর্তমানে শীত কমে যাওয়ায় রসের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে।’
তিনি আরো বলেন, আমার ভাই ভানি কান্ত শীল ৩০০ গাছ কাটে।
গোল গাছ মালিক নিবিড় মজুমদার বলেন, এখন গুড় উৎপাদন হলেও আগের মতো লাভবান হওয়া যায় না। কারণ, প্রতি কলস রস জাল দিতে খড় সংগ্রহের জন্য শ্রমিক খরচ হয় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আগে মাটির কলসিতে রস আহরণ করতাম। এখন মাটির কলস কিনতে পাওয়া যায় না। তাই পানির প্লাষ্টিকের বোতলে রস আহরণ করতে হয়।
শুভংকর দেবনাথ বলেন, ‘আমি ২০০ গাছ কাটি। তবে আমরা গুড়ের ন্যায্য মূল্য পাই না। বাজারে প্রতি কেজি খেজুর গুড় ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। কিন্তু আমরা প্রতি কেজি গোলের গুড়ের মূল্য পাই মাত্র ১২০ টাকা।
বাসুদেব শীল বলেন, ‘আমি নিজের ও বর্গা মিলিয়ে ৩০০ গাছ কাটি। তীব্র শীতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ কলস রস পেতাম। এখন শীত কমে যাওয়ায় প্রতিদিন ছয় থেকে আট কলস রস পাই।
তিনি বলেন, ‘গোলের এ রস প্রতি কলস ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ও গুড় প্রতি কেজি ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়। এক কলস রস দিয়ে তিন কেজি গুড় তৈরি হয়। এজন্যই এক কলস রস ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি করা হয়।
গোলগাছ মালিক অটল পহলান বলেন, গোলগাছ বাঁচিয়ে রাখতে বৈশাখ মাসে জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে গাছের গোড়া ভিজিয়ে দিতে হয়। কিন্তু লবণাক্ত পানিতে কৃষি জমি নষ্ট হয়। এখন লবণাক্ত পানি উঠানো বন্ধ করে দেয়ায় গোল গাছ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
গোল গাছের রস দিয়ে যেমন গুড় তৈরি হয়, তেমনি গুড় তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায় তার পরিত্যক্ত ডগা। এছাড়াও গোল পাতা বিক্রি করেও প্রচুর টাকা আয় করেন গাছিরা।
গোলপাতা দিয়ে বাসা-বাড়ির রান্নাঘরের ছাউনি ও গোয়াল ঘরের ছাউনি দেয়া যায়। সব মিলিয়ে একটি গোল গাছ তিন ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়।
তালতলী কৃষি অফিসার মো: সুমন হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের কাছে গোল গাছের যে তথ্য আছে, সেটা আনুমানিক। গোল গাছ কৃষি বিভাগের আওতায় নয়। এটি সুগার ক্রপ গবেষণার আওতায়। আমরা মাঠের কৃষকদের নিয়ে কাজ করে থাকি।